বিআইডব্লিউটিএ নিয়মিত প্রকাশনা

বুধবার, জানুয়ারি ২২, ২০২৫
17 C
Dhaka

বিআইডব্লিউটিএ নিয়মিত প্রকাশনা

কিল্লা আওরঙ্গবাদ: বুড়িগঙ্গাকে আশ্রয় করে প্রাসাদ দুর্গ

নদীবাংলা ডেস্ক,

ঢাকার নিরাপত্তায় একাধিক নৌ-দুর্গের পাশাপাশি তিনটি প্রাসাদ দুর্গও নির্মাণ করেন মুঘল শাসকরা। বুড়িগঙ্গার তীরে কিল্লা আওরঙ্গবাদ বা লালবাগের দুর্গ ছিল চার স্তরের নিরাপত্তা কৌশলের অন্যতম অংশ।

বাংলার ইতিহাস বহু প্রাচীন হলেও নগরকেন্দ্র হিসেবে ঢাকার পরিচিতি খুব পুরনো নয়। যদিও বাংলায় ‘দাবাকা’ নামে একটি স্থানের উল্লেখ আছে সমুদ্রগুপ্তর (চতুর্থ খ্রিস্টাব্দ) ‘এলাহাবাদ প্রশস্তি’তে। অনেকের মতে, ঢাকায় বসতি স্থাপন সম্পর্কে এটাই সবচেয়ে প্রাচীন দলিল। এরপর সপ্তম খ্রিস্টাব্দে এসে কামরূপের বৌদ্ধ সাম্রাজ্যের অধীনে ঢাকায় ছোট ছোট শহুরে স্থাপনা গড়ে ওঠে। নবম খ্রিস্টাব্দের পর ঢাকা ছিল বিক্রমপুরের সেন রাজাদের অধীনে।

ইউরোপীয়দের বয়ানে সেই সময় ঢাকার পরিচিতি ছিল বাঙ্গালা হিসেবে। বলা হয়ে থাকে, সেটা ছিল দুলাই নদীর পাড়ে গড়ে ওঠা ‘বায়ান্ন বাজার, তেপান্ন গলি’র ছোট্ট শহর। কালের পরিক্রমায় নানা শাসকের করতলে এসেছে ঢাকা। মুঘল শাসনের আগ পর্যন্ত ১২৯৯ থেকে ১৬০৮ সাল পর্যন্ত ঢাকার নিয়ন্ত্রণ ছিল তুর্কি ও পাঠানদের হাতে। এরপর সোনারগাঁর শাসকদের হাত ঘুরে আসে মুঘল শাসনের অধীনে। বাংলার প্রথম মুঘল ভাইসরয় সুবেদার ইসলাম খাঁ ১৬১০ সালে তাঁর রাজধানী রাজমহল থেকে ঢাকায় সরিয়ে আনেন এবং এর নতুন নাম দেন জাহাঙ্গীরনগর। সেই সাথে সুবাহ-বাংলার রাজধানী হিসেবে ঢাকার গুরুত্বও অনেক বেড়ে যায়। মুঘল সাম্রাজ্যের বড়সড় রাজস্বের জোগানদাতা সুবাহ-বাংলার রাজধানী হিসেবে ঢাকার নগরায়ণে নতুন ধরনের গতি পায়। ইব্রাহিম খাঁর শাসনকালে বাণিজ্যিক দিক থেকে ঢাকার গুরুত্ব অন্য উচ্চতায় পৌঁছে। আরব, পারস্য, আর্মেনিয়া, চীন, মালয়া, জাভা ও সুমাত্রার সাথে বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে এই সময়েই। পিছিয়ে ছিলেন না ইউরোপীয় বণিকরাও। ১৬১৬ খ্রিস্টাব্দ থেকে পর্তুগিজ, ডাচ, ইংরেজ ও ফরাসিরাও ব্যবসার প্রয়োজনে ঢাকায় আসতে থাকেন। মাঝে কয়েক বছরের জন্য ১৬৪০ সালে শাহ সুজা রাজধানী রাজমহলে ফিরিয়ে নিলেও বাণিজ্য কেন্দ্র হিসেবে ঢাকার মহিমায় এতটুকুও ধুলো জমেনি। ১৬৬০ সালে মীর জুমলার হাত ধরে ঢাকা আবার সুবাহ-বাংলার রাজধানীর স্বীকৃতি ফিরে পায়। বলা যায়, ১৭ শতকটি ছিল ঢাকার ইতিহাসে এক স্বর্ণালি যুগ। শায়েস্তা খাঁর আমলে সব দিক দিয়েই উন্নতির শিখরে পৌঁছে যায় ১০ লাখ মানুষের শহরটি। ফরাসি পরিব্রাজক জাঁ-ব্যাপ্টিস্ট তাভার্নিয়ের ১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দে ঢাকাকে দেখে বলেছিলেন, ‘ঢাকা দারুণ শহর। শহরটির দৈর্ঘ্য প্রায় দুই লিগ।’

মুঘল আমলে ঢাকার আয়তন ও জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সমানতালে গড়ে উঠতে থাকে নান্দনিক সব স্থাপনা। এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো লালবাগের দুর্গ, সম্ররাট আওরঙ্গজেবের নামানুসারে শায়েস্তা খাঁ যার নাম দিয়েছিলেন কিল্লা আওরঙ্গবাদ। যুবরাজ মুহম্মদ আজম বাংলার সুবাহদার থাকাকালে ১৬৭৮ খ্রিস্টাব্দে এর নির্মাণকাজ শুরু করেন। নির্মাণ শেষ না করেই তাঁকে দিল্লি ফিরে যেতে হয়। এরপর শায়েস্তা খাঁ ১৬৮৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ঢাকায় অবস্থান করলেও দুর্গের নির্মাণ শেষ করেননি।

ঢাকার নিরাপত্তা কৌশলের অংশ

বাণিজ্যের পাশাপাশি সামরিক কৌশলগত দিক বিবেচনায়ও ঢাকার গুরুত্ব কম ছিল না। প্রাচীন বাংলার রাজধানী বিক্রমপুর ও মধ্যযুগে বাংলার রাজধানী সোনারগাঁ উভয়ের খুব সন্নিকটে ঢাকার অবস্থান। স্বাভাবিকভাবেই ওই দুই নগরীর পাশাপাশি রাজধানীর নিরাপত্তায় বাণিজ্যিক কেন্দ্র ঢাকা ক্রমে ক্যান্টনমেন্ট শহরও হয়ে উঠতে থাকে। গড়ে ওঠে বেশকিছু স্থায়ী দুর্গ। যদিও মুঘল-পূর্ব সময়েও বেশ কিছু দুর্গ ছিল, তবে সেগুলো মাটির।

ঢাকার নিরাপত্তায় নৌ-দুর্গের পাশাপাশি তিনটি প্রাসাদ দুর্গও গড়ে তোলেন মুঘল শাসকরা। এর মধ্যে যুবরাজ আজম ও শায়েস্তা খাঁ গড়ে তোলেন লালবাগ দুর্গ। জিঞ্জিরা দুর্গটি গড়ে তোলেন ইব্রাহিম খাঁ। লালবাগ দুর্গের দক্ষিণে ঢাকার পোস্তা এলাকায় আরও একটি প্রাসাদ দুর্গ নির্মাণ করেন যুবরাজ আজিম-উস-শান। এই প্রাসাদ দুর্গটি পরে বুড়িগঙ্গায় বলিন হয়ে যায়।

এসব প্রাসাদ দুর্গের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে ধরা হয় কিল্লা আওরঙ্গবাদ বা লালবাগ দুর্গকে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে দুর্গটি নির্মাণের উদ্দেশ্য কী? মুঘল শাসনামলে বাংলা সমৃদ্ধশালী প্রদেশ হওয়ার কারণেই বারবারই একে দস্যুদের আগ্রাসনের শিকার হতে হয়েছে। পর্তুগিজ ও মগ দস্যুরা শীতলক্ষ্যা নদী হয়ে ঢাকার দিকে অগ্রসর হওয়ার চেষ্টা নিয়মিতই করে গেছেন। ঢাকায় পৌঁছানোর আগে সোনারগাঁ ও বিক্রমপুরেও নজর থাকত তাদের।

এই আগ্রাসন থেকে ঢাকাকে রক্ষায় চার স্তরের নিরাপত্তা কৌশল অবলম্বন করেন মুঘল শাসকরা। প্রথম স্তরটি ছিল ত্রিভুজাকৃতির প্রতিরক্ষা কৌশল। এজন্য ঢাকার বাইরে তিনটি নৌ-দুর্গ নির্মাণ করা হয়। দ্বিতীয় স্তরের প্রতিরক্ষা কৌশল সাজানো হয় ফতুল্লায় দুটি দুর্গকে কেন্দ্র করে। তৃতীয় স্তরের নিরাপত্তা কৌশলের কেন্দ্রে ছিল পোস্তগোলার পোস্তকিল্লা এবং দুলাই খালের উভয় পাশে নির্মিত বেগ মুরাদ কিল্লা ১ ও ২। চতুর্থ ও সর্বশেষ কৌশলটি করা হয়েছিল ঢাকার প্রধান তিনটি দুর্গকে সামনে রেখে। এর অন্যতম হচ্ছে লালবাগ দুর্গ। পুরাতন ঢাকার দক্ষিণ-পশ্চিম অংশে বুড়িগঙ্গা তীরের দুর্গটি একটি প্রাসাদ দুর্গ।

বুড়িগঙ্গার তীরে যে কারণে কিল্লা আওরঙ্গবাদ নির্মিত হয়েছিল বুড়িগঙ্গার তীর ঘেঁষে। ডয়েলির অঙ্কিত চিত্রে (১৮০৯-১১) দেখা যায়, পূর্ব-পশ্চিমে আয়তাকারে বিস্তৃত দুর্গের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিম অংশের অর্ধেকেরও বেশি নদীসংলগ্ন। দুর্গে পানি সরবরাহ ব্যবস্থা দেখলেও অবস্থান হিসেবে বুড়িগঙ্গার তীরকে বেছে নেওয়ার কারণ সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। নদী থেকে পানি দুর্গে আনতে দক্ষিণ-পশ্চিম কোণের বুরুজের কাছেই তৈরি করা হয় একটি ওয়াটার হুইল বা ওয়াটার টাওয়ার। মনুষ্যচালিত ওয়াটার হুইলের সাহায্যে বুড়িগঙ্গা থেকে পানি টেনে আনা হতো দুর্গের প্রধান দুটি চ্যানেলে। একটি চ্যানেল চলে গেছে মসজিদের দিকে, আরেকটি ছাদবাগানের দিকে। দুর্গের পূর্ব দিকে ছিল বিশালাকৃতির একটি রিজার্ভার, যা ব্যালাস্ট ট্যাংক হিসেবে কাজ করত। দক্ষিণ গেটের পাশেও সম্ভবত আরেকটি ওয়াটার হুইল ছিল, যার সাহায্যে সরাসরি রিজার্ভারে পানি আনা হতো।

মুঘল আমলের এই অপূর্ব স্থাপত্যটি ছিল যুবরাজ আজম শাহের স্বপ্ন, যা পূর্ণতা পায়নি। অসম্পূর্ণ দুর্গটিই ১৮৪৪ সালে ব্রিটিশদের কাছে স্থায়ী ইজারা দেওয়া হয়। এরপর ব্রিটিশরা একে পুলিশ সদর দপ্তরে রূপান্তরিত করে। দুর্গের ভেতরেই তারা অসংখ্য ভবন নির্মাণ করে। মুঘল আমলের নকশাতেও পরিবর্তন আনা হয় এই সময়। স্বাধীনতার পর ১৯৭৪ সালে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ দুর্গটি সংরক্ষণের উদ্যোগ নেয়।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here