পূর্বে মেঘনা, পশ্চিমে শীতলক্ষ্যা, দক্ষিণে ধলেশ্ব ও উত্তরে ব্রহ্মপুত্র দ্বারা পরিবেষ্টিত সোনারগাঁ। এক সময় রাজধানী হিসেবে সোনারগাঁকে বেছে নেওয়ার কারণ ছিল এই নদী ও নৌ-যোগাযোগের সুবিধা। সামরিক সুবিধার কথাও বিবেচনায় ছিল হয়তো। আর এই সোনারগাঁরই একটি নগর পানাম।
ইবনে বতুতা চট্টগ্রাম বন্দর হয়ে নদীপথে সুনুরকাওয়ানে পৌঁছেছিলেন ১৩ শতকে। সুনুরকাওয়ান (সোনারগাঁও) সম্পর্কে বিশেষ কোনো তথ্য পরিব্রাজক ইবনে বতুতার বয়ানে পাওয়া যায় না। তবে বাংলার প্রাচীন জনপদ হিসেবে এই সোনারগাঁর রয়েছে সমৃদ্ধ ও গৌরবোজ্জ্বল ঐতিহ্য।
ধারণা করা হয়, রাজা দনুজমাধব দশরথ ১২৮৩ খ্রিস্টাব্দে বা তার আগে কোনো এক সময়ে বিক্রমপুর থেকে তার রাজধানী সুবর্ণগ্রামে সরিয়ে নেন। রাজধানী হিসেবে সোনারগাঁকে বেছে নেওয়ার কারণ ছিল সম্ভবত নদী ও নৌ-যোগাযোগের সুবিধা। পূর্বে মেঘনা, পশ্চিমে শীতলক্ষ্যা, দক্ষিণে ধলেশ্বরী ও উত্তরে ব্রহ্মপুত্র দ্বারা পরিবেষ্টিত ছিল এই সোনারগাঁ। সামরিক সুবিধার কথাও বিবেচনায় ছিল হয়তো। ইতিহাসবিদ নীহাররঞ্জন রায় তার বাঙ্গালীর ইতিহাস (আদি পর্ব) গ্রন্থে তারই উল্লেখ করেছেন ‘লক্ষ্যা-সঙ্গমের অদূরবর্তী সুবর্ণগ্রামের অবস্থিতি যে সামরিক দিক থেকে গুরুত্বময়, সে কথা স্বীকার করতেই হয়।’ ঈশা খাঁ ও তার বংশধরদের শাসনামলেও পূর্ববঙ্গের রাজধানী ছিল সোনারগাঁ।
সোনারগাঁ নামটি কিভাবে এলো তা নিয়ে নানা কিংবদন্তী প্রচলিত আছে। কারো কারো মতে, প্রাচীন সুবর্ণগ্রামই পরিবর্তীত হয়ে সোনারগাঁ নাম ধারণ করেছে। আবার এমন ধারণাও আছে যে, বারো ভূঁইয়া অন্যতম ঈশা খাঁর স্ত্রীর নাম ছিল সোনাবিবি। তার নামানুসারেই সোনারগাঁ নামকরণ করা হয়। বড় নগর, খাস নগর ও পানাম নগর নামে তিনটি নগরী গড়ে ওঠে সোনারগাঁয়ে। এই তিন নগরের মধ্যে পানাম ছিল সবচেয়ে আকর্ষণীয়। সোনারগাঁর ২০ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে গড়ে ওঠা এই নগর বাংলার বারো ভূঁইয়ার ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আছে।
অবস্থান
শীতলক্ষ্যা পাড়ের এক সময়ে ঐতিহ্য পানাম নগরের অবস্থান ঢাকা থেকে ৩০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে। মুঘলদের সোনারগাঁ অধিকারের (১৬১১) পর মহাসড়ক ও সেতু নির্মাণ করে রাজধানী শহরের সঙ্গে পানাম এলাকার সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন করা হয়। মুঘল আমলের ইটনির্মিত তিনটি সেতু এখনো কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এগুলো হলো পানাম সেতু, দালালপুর পুল ও পানামনগর সেতু। সেতুগুলোর অবস্থান এবং পানামের তিন দিকের খালই বলে দেয় যে, এলাকাটি মধ্যযুগীয় উপশহর ছিল।
ঔপনিবেশিক আমলে সুতিবস্ত্রের বিশেষ করে ইংলিশ থান কাপড়ের ব্যবসার কেন্দ্র হয়ে ওঠে সোনারগাঁ এবং এরই সুবাদে গড়ে ওঠে উপশহরটি। উনিশ শতকে ব্যবসায়ীদের মধ্য থেকে উঠে আসা কিছুসংখ্যক হিন্দু তালুকদার স্থানটিকে আবাসস্থল হিসেবে বেছে নেন। কে কত দৃষ্টিনন্দন ইমারত নির্মাণ করতে পারেন তার একটা প্রতিযোগিতা ছিল সে সময়।
স্থাপত্যশৈলী
পানাম নগর ছিল বিশেষ বৈশিষ্ট্যপূর্ণ একটি শহর। পূর্ব-দক্ষিণে বিস্তৃত প্রায় ৬০০ মিটার দীর্ঘ ও ৫ মিটার প্রশস্ত একটিমাত্র সড়কের দুই পাশে সুরম্য ৫২টি ভবন নিয়ে পানাম নগর গড়ে ওঠে। ভবনগুলোর অধিকাংশই আয়তাকার এবং উত্তর-দক্ষিণে বিস্তৃত। ছোট ছোট লাল ইটের তৈরি ইমারতগুলোর স্থাপত্যশৈলী যে কারোরই নজর কাড়বে। ভবনগুলো কোথাও একটা আরেকটা থেকে বিচ্ছিন্ন, কোথাও আবার লাগোয়া।
ভবনগুলো উচ্চতায় এক থেকে তিন তলা। ইমারতগুলোর অবয়ব ও নকশায় বেশ কিছু সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া যায়, যেমন উচ্চতা ও খিলান। বারান্দা, ঝুলবারান্দা বা অলিন্দ, উন্মুক্ত গ্যালারি ও দেউড়ি সংযোজনের ক্ষেত্রে আবার বৈচিত্র্য ধরা পড়ে। ইউরোপীয় স্থাপত্যশৈলীর অনুকরণে করা হয়েছে ইমারতগুলোর অলঙ্করণ। তবে কোথাও কোথাও স্থানীয় নকশাও যে ব্যবহৃত হয়নি তেমন নয়। ইমারতের অভ্যন্তরভাগের কারুসজ্জায় প্রায় সর্বত্রই চীনামাটির বাসনের টুকরা ব্যবহৃত হয়েছে। বহির্ভাগের অলঙ্করণে এর ব্যবহার কদাচিৎ দেখা যায়। খিলান ও ছাদের মধ্যবর্তী স্থানে বিস্তৃত অলঙ্করণ চোখে পড়ে।
ইমারতের দেয়ালগুলো ৫০ থেকে ৭০ সেন্টিমিটার পুরু। প্রায় সব ইমারতেই অঙ্গসজ্জার উপকরণ হিসেবে কাঠের দরজা-জানালার অনুকরণে প্লাস্টারে তৈরি কৃত্রিম দরজা ও জানালা ব্যবহার করা হয়েছে।
নকশা অনুযায়ী পানামের বসতবাড়িগুলোকে মূলত তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়: মধ্যবর্তী হলঘরসংবলিত ধরন, মধ্যবর্তী অঙ্গন (উঠান) সংবলিত ধরন ও সমন্বিত ধরন। মধ্যবর্তী হলঘর ইমারতের সংযোগকেন্দ্র হওয়ায় এগুলোকে ব্যাপক অলঙ্করণের মাধ্যমে সৌন্দর্যমণ্ডিত করে তোলা হয়েছে। অঙ্গনের চারপাশ ঘিরে নির্মাণ করা হয়েছে অন্যান্য কক্ষ। অঙ্গনের ভিত পাকা এবং এর উপরিভাগ ছাদহীন, উন্মুক্ত। সাধারণভাবে অঙ্গনের চারপাশে রয়েছে বারান্দা এবং এ বারান্দায় রয়েছে খিলানাকার দ্বারপথ। সমন্বিত ধরনের বাড়িগুলোর অভ্যন্তরে কোনো অঙ্গন বা হলঘর নেই। পানামের অধিকাংশ বাড়ি বিশেষ করে একতলা বাড়িগুলো এ ধরনের।
২০০৬ সালে বিশ্বের ১০০টি ধ্বংসপ্রায় নগরীর তালিকা করে ওয়ার্ল্ড মনুমেন্ট ফান্ড। পানাম নগরও আছে সেই তালিকায়।