ঢাকা-ময়মনসিং সড়কে অবস্থিত টঙ্গী পুল নির্মাণ করেছিলেন খান খানান মেয়াজ্জখাঁ (মীর জুমলা) ১৬৬১ সালে। ঢাকা থেকে তাঁর সৈন্যবাহিনী যাতে সহজেই আসতে পারে সে লক্ষ্যেই সেতুটি নির্মাণ করেছিলেন তিনি। তবে কেউ কেউ বলেন, শাহ টঙ্গী নামক জনৈক ফকির নবাব ইব্রাহিম খাঁর সময় পুলটি নির্মাণ করেছিলেন।
মুসলিম-পূর্ব যুগে ঢাকার স্থাপত্যের নিদর্শন সেভাবে দৃশ্যমান নয়। মুসলিম-পূর্ব যে দুই-একটি স্থাপত্য এখনো অবশিষ্ট আছে তার মধ্যে একটি হলো নারিন্দায় ১৪৫৭ সালে নির্মিত বিনাত বিবি মসজিদ। মোঘল-পূর্ব সময়ে আরেকটি স্থাপত্যের খোঁজ দিয়েছেন আওলাদ হোসেন। সেটি হচ্ছে নাসওয়ালা গলিতে ১৪৫৯ সালে নির্মিত ধ্বংসপ্রাপ্ত একটি মসজিদের ফটক।
ঢাকায় স্থাপত্যের ঊষালগ্ন শুরু হয় ইসলাম খানের আগমনের পর। রাজধানীর সুরক্ষায় বেশ কিছু দুর্গ নির্মাণ করেন এই মোঘল শাসক। ১৬০৮ সালে শুরু হওয়া ঢাকার এই প্রাচুর্যের ক্ষয় শুরু হয় ১৭০৬ সালে আজিমুশ শানের প্রস্থানের মধ্য দিয়ে। এই সময়ের মধ্যে ঢাকা বিস্তৃত হয়েছিল দক্ষিণে বুড়িগঙ্গা থেকে উত্তরে টঙ্গী সেতু এবং পশ্চিমে জাফরাবাদ থেকে পূর্বে পোস্তগোলা পর্যন্ত।
মোঘলদের অধীনে ঢাকা যখন স্বর্ণালি সময় অতিবাহিত করছে, সেই সময় তুরাগ নদের ওপর একটি সেতু নির্মিত হয়। ঢাকার উত্তর সীমায় বুড়িগঙ্গা নদী থেকে এর অবস্থান ১৪ মাইলের মতো দূরে। এই সেতুই ইতিহাসখ্যাত টঙ্গী পুল।
ঢাকা-ময়মনসিং সড়কে অবস্থিত মূল সেতুটি নির্মাণ করেছিলেন সম্ভবত খান খানান মেয়াজ্জখাঁ (মীর জুমলা) ১৬৬১ সালে। ওই সময় তিনি বাংলার সুবেদার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। ঢাকা থেকে তার সৈন্যবাহিনী যাতে সহজেই আসতে পারে সে লক্ষ্যেই সেতুটি নির্মাণ করেছিলেন তিনি। তবে কেউ কেউ বলেন, শাহ টঙ্গী নামক জনৈক দরবেশ নবাব ইব্রাহিম খাঁর সময় সেতুটি নির্মাণ করেন। যদিও মীর জুমলা নির্মিত পাগলা পুলের গঠনপ্রণালি টঙ্গী পুলের অনুরূপ হওয়ায় টঙ্গী পুলও মীর জুমলা কর্তৃক নির্মিত বলে মনে করা হয়। সে যাই হোক, টঙ্গী নামটি যে ওই এলাকায় বসবাসকারী দরবেশ শাহ টঙ্গীর নাম থেকেই এসেছে তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
বলা হয়ে থাকে, ঢাকা শহরের উত্তরে এই সেতুটি নির্মিত হয়েছিল টঙ্গী খালের ওপর। কেন্দ্রে তিনটি বাঁকানো ও চাকরি কেন্দ্রীয় এবং প্রত্যেক প্রান্তে একটি করে খিলানের সমন্বয় ঘটানো হয় সেতুটিতে। দুই খিলান ও ছাদের মাঝামাঝি অংশ সজ্জিত করা হয় গোলাপের কারুকার্যে। খিলানগুলোর নিচের অংশ ছিল অর্ধ-বৃত্তাকার জাহাজের মাস্তুল সদৃশ। ভারতবর্ষের অন্য সব মোঘল স্থাপত্যের মতো টঙ্গী পুলেরও দুই প্রান্তে ছিল গম্বুজ আকৃতির দুটি ওয়াচ টাওয়ার।
শিল্পী ও সিভিল সার্ভেন্ট স্যার চার্লস ড’য়লি সেতুটির দৃষ্টিনন্দন স্কেচ এঁকেছিলেন, যা লিপিবদ্ধ রয়েছে ‘অ্যান্টিকুইটিজ অব ঢাকা’তে। ১৮০৮ থেকে ১৮১১ পর্যন্ত ড’য়লি ছিলেন ঢাকার কালেক্টর। ঢাকায় অবস্থানকালে তিনি বেশকিছু ড্রইং করেন এবং তা ফোলিয়ো আকারে প্রকাশের সিদ্ধান্ত নেন। ঢাকার ইতিহাস চর্চায় চার্লস ড’য়েলির ‘অ্যান্টিকুইটিজ অব ঢাকা’ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মূলত এটি ঢাকা বিষয়ক ছবির ফোলিয়ো। পাশাপাশি এতে ঢাকার ইতিহাস সম্পর্কিত একটি নাতিদীর্ঘ বিবরণ। এ কারণে, অ্যান্টিকুইটিজকে অনেকে বই হিসেবেও উল্লেখ করেন। এক হিসেবে ‘অ্যান্টিকুইটিজ’ চারজনের পরিশ্রমের ফল। মূল ছবি ড’য়লির। ঢাকা বিষয়ক বিবরণ জেমস অ্যাটকিনসনের ও ভিগনেট চিনারির, আর এনগ্রেভার ল্যান্ডসিয়ার। তৃতীয় ফোলিয়োতে এনগ্রেভিং আছে চিনারির আঁকা ‘রুইন্স অব টঙ্গী ব্রিজ’। টঙ্গীর পুলের ছবি এঁকেছেন হেনরি ব্রিজেস মোলসওর্থও (১৮৫৫-১৯৫৪)।
গবেষক এস. এম. তাইফুরের পর্যবেক্ষণে, টঙ্গী সেতুর নির্মাণশৈলী পাগলা পুলের অনুরূপ। ১৮৫৭ সালে সিপাহি বিদ্রোহের সময় ঢাকার তৎকালীন ম্যাজিস্ট্রেট মি. কার্নাকের নির্দেশে টঙ্গীর পুলটি উড়িয়ে দেওয়া হয়। পরে কাঠ দিয়ে নতুন আরেকটি সেতু নির্মাণ করা হলেও ১৮৯০ সালে বন্যার তোড়ে সেটি ভেসে যায়। তবে মূল সেতুটির ভগ্নাংশ ১৮৯৫ সাল পর্যন্তও দণ্ডায়মান ছিল।
গবেষক খন্দকার আলমগীরের ভাষায়, তথ্য যাচাইয়ের পর বয়স্ক ব্যক্তি ও স্থানীয় ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে ২০১৫ সালে জানা যায়, বর্তমানে টঙ্গীর যে সেতু সেটি আদি টঙ্গী পুল নয়। বর্তমানে টঙ্গীর যে জোড়া সেতু তার পূর্ব অংশ নির্মিত হয় ১৯৬০ এর দশকে। পশ্চিম অংশটি নির্মিত হয় ১৯৮০ এর দশকে। আদি মোঘল সেতুটি ছিল বর্তমান সেতুটির খানিকটা পূর্বে। বিধ্বস্ত টঙ্গী পুলের দক্ষিণ দিকের যে সড়ক, সেটি এখন পরিচিত পেপার মিল রোড নামে।
উনিশ শতকে ঢাকায় বসবাসকারী ইংরেজদের কাছে শিকারের স্থান হিসেবে টঙ্গী সেতুর আলাদা আবেদন ছিল। ইতিহাসবিদ জেমস অ্যাটকিনসন সেই সময় লিখেছিলেন, যদিও সেতুটির অনেকটাই ভগ্নদশা তারপরও স্পষ্ট এবং নান্দনিক আকর্ষণ ঢাকার পুরাকীর্তির সঙ্কলনে আমাদের বিবেচনার জোর দাবিদার। এর বিশাল আকৃতি বটের শিকড় আর পত্র-পল্লবে চমৎকারভাবে মিশে গেছে।