ডিজিটালাইজেশনে নতুন নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত হচ্ছে নিয়ত। অভ্যন্তরীণ নৌপথেও ধীরে ধীরে স্মার্ট শিপিংয়ের সম্ভাবনা উঁকি দিচ্ছে। আর এই সম্ভাবনা লুকিয়ে আছে ইনল্যান্ড ওয়াটারওয়েজ ভেসেল ট্রেন ও দূর-নিয়ন্ত্রিত নৌযান থেকে শুরু করে পণ্য ও যাত্রী পরিবহনের জন্য ড্রোনের ন্যায় ছোট প্ল্যাটফরমের মধ্যে।
স্মার্ট শিপিং আসলে কী? এর সংজ্ঞা দিতে গিয়ে নৌপরিবহন অবকাঠামোর বৈশ্বিক সংগঠন দ্য পার্মানেন্ট ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অব নেভিগেশনাল কংগ্রেস (পিআইএএনসি) বলেছে, অবকাঠামোর জোগানদাতা ও ট্রাফিক ব্যবস্থাপকদের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে স্মার্ট শিপিং বলতে কেবল অটোনোমাস ভেসেল বোঝায় না। এটি আরও অনেক বিস্তৃত। স্মার্ট শিপিং ব্যাপক অর্থে ব্যবহৃত একটি পরিভাষা, যেখানে চারটি অনুষঙ্গ অপরিহার্য।
স্মার্ট শিপিংয়ের ক্ষেত্রে প্রথম যে অনুষঙ্গটির কথা সবার আগে আসে তা হলো স্মার্ট ভেসেল। সেগুলোকেই আমরা স্মার্ট ভেসেল বলব, যেগুলো উচ্চমাত্রায় স্বয়ংক্রিয়। গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো সম্পাদনে ডেটা ব্যবহারের জন্য সেগুলোতে অটোমেটেড সিস্টেমের সন্নিবেশ থাকা বাঞ্ছনীয়। আরেকটি অনুষঙ্গ হলো স্মার্ট ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা ও অবকাঠামো। এক্ষেত্রে অভ্যন্তরীণ নৌপথ ব্যবস্থাপনার দায়িত্বপ্রাপ্তদের জাহাজ, অবকাঠামো ও তৃতীয় পক্ষের কাছ থেকে আগত রিয়েল-টাইম ডেটাকে বিবেচনায় নিতে হয়। পাশাপাশি ব্রিজ/লক অপারেটর, ট্রাফিক পরিকল্পনাকারী এবং ভেসেল ট্রাফিক সেবা বা ট্রাফিক নির্দেশনায়ও পরিবর্তন আনতে হবে। তৃতীয় অনুষঙ্গটি হচ্ছে স্মার্ট ভ্রমণ ও পরিবহন। এক্ষেত্রে জাহাজ ও তৃতীয় পক্ষের লজিস্টিকস সেবাদাতাদের মধ্যকার যোগাযোগ হতে হয় স্মার্ট, নির্বিঘ্ন ও নমনীয়। এখানে দুটি অংশ রয়েছে। একটি হচ্ছে প্রক্রিয়াগুলোর সরলীকরণ ও আন্তর্জাতিক অন্তর্ভুক্তিকরণ, যা অভ্যন্তরীণ নৌপথ ব্যবহারকারীদের অনুসরণ করতে হয়। দ্বিতীয়টি হচ্ছে, নেভিগেশন ও কার্গো হ্যান্ডলিং পদ্ধতিকেও হতে হবে স্মার্ট। চতুর্থ ও সর্বশেষ অনুষঙ্গটি স্মার্ট নিয়ন্ত্রণ। অর্থাৎ, নিয়ন্ত্রণ অথবা পরিদর্শনের কাজে জাহাজ ও তৃতীয় পক্ষের মধ্যে স্মার্ট যোগাযোগ।
প্রযুক্তির যে উন্নয়ন এবং অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন খাতে এর ব্যবহারের যে প্রবণতা তাতে বলা যায়, স্মার্ট ভেসেল ও আনুষঙ্গিক অন্যান্য সমস্যার স্মার্ট সমাধান আগামীতে আরও বাড়বে। এখনই প্রযুক্তি যে স্তরে পৌঁছেছে তার সুবাদে নৌযান আগের চেয়ে অনেক বেশি কাজ করতে পারছে। তাছাড়া স্মার্ট শিপিং অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন খাতের অংশীজনদের কাজেও মৌলিক পরিবর্তন আনবে, যা তাদের দক্ষতাকে আরও বাড়িয়ে দেবে। স্মার্ট শিপিংয়ের এই আলোচনাকে সময়ের আগে বলে মনে হতে পারে। কারণ, অভ্যন্তরীণ নৌপথে স্বয়ংক্রিয় নৌযান চলাচলের নজির এখন পর্যন্ত তৈরি হয়নি। তবে ড্রোন এবং স্বয়ংক্রিয় ছোট নৌযানের অভিজ্ঞতা এরই মধ্যে হয়েছে। তবে আশার কথা হলো এ খাতে প্রভাব ফেলতে পারে এমন অনেক উন্নয়ন সামনের বছরগুলোতে নিশ্চিতভাবেই দেখা যাবে।
স্মার্ট শিপিং ধারণাটি নিয়ে যে হারে গবেষণা ও অবকাঠামোর দ্রুত উন্নয়ন হচ্ছে, অবকাঠামো ও ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার ওপর এর প্রভাব নিয়ে গবেষণা সে হারে গুরুত্ব পাচ্ছে না। যদিও এটাও একইভাবে গুরুত্বপূর্ণ। তাছাড়া সরবরাহ শৃঙ্খলের অংশ হিসেবে স্মার্ট শিপিংকে পর্যালোচনায় নেওয়াটাও জরুরি। এ সংক্রান্ত জ্ঞান উন্নয়নে অবকাঠামো সরবরাহকারী, ট্রাফিক ব্যবস্থাপক ও অভ্যন্তরীণ নৌপথকে বিনিয়োগে এগিয়ে আসতে হবে। সেই সাথে আগামীতে কী ঘটতে যাচ্ছে সে ব্যাপারেও তৈরি থাকা দরকার।
স্মার্ট শিপিংয়ের ফলাফল নিয়ে বিস্তারিত গবেষণা না হলেও এর ফলে বাড়তি কী সুবিধা আসতে পারে সে সম্পর্কে কিছুটা হলেও আগাম ধারণা করা যায়। স্মার্ট ভেসেল ও স্মার্ট শিপিংয়ের প্রভাব হবে ব্যাপক। অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন খাতকে এটি কতটা নিরাপদ, টেকসই এবং প্রতিযোগিতাসক্ষম করবে তা এখনো আলোচনার বিষয়। তারপরও কিছু গবেষণা বলছে, অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন খাতের দক্ষতা, নিরাপত্তা, টেকসই এবং প্রতিযোগিতাসক্ষম ইতিবাচক প্রভাব রাখবে স্মার্ট শিপিং। তবে এটা অনেকখানি নির্ভর করছে অটোমেশন কতটা উচ্চতায় পৌঁছেছে তার ওপর।
আগেই বলা হয়েছে যে, অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন খাতে স্মার্ট শিপিং একটি নতুন ধারণা, যার উন্নয়ন ঘটছে। এ ছাড়া অভ্যন্তরীণ নৌপথে স্বয়ংক্রিয় নৌযান চলাচলের নজিরও এখন সৃষ্টি হয়নি। তাই বলা যায়, স্মার্ট শিপিংয়ের ক্ষেত্রে সব দেশই রূপান্তরের পর্যায়ে রয়েছে। তবে এ নিয়ে অনেক কাজ হচ্ছে এবং রূপান্তরের এই প্রক্রিয়ায় স্মার্ট শিপিং নিয়ে সাধারণ বোঝাপড়া, পরস্পরের মধ্যে অভিজ্ঞতা বিনিময় করা এবং অবকাঠামোর ওপর সম্ভাব্য প্রভাব ও ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা নিয়ে আলোচনার মধ্যে সব দেশেরই স্বার্থ লুকিয়ে আছে।
সবশেষে আগামী দিনের নৌ চলাচলে স্বয়ংক্রিয় পরিবহনের ক্ষেত্রে উদ্ভাবনকে অস্বীকার করার উপায় নেই। অটোনোমাস ড্রাইভিং ও ট্রাক প্লাটুনিং সড়ক পরিবহনের ব্যয় কমিয়ে আনবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। সেই সাথে এর নমনীয়তাও বৃদ্ধি করবে। এছাড়া রেল করিডোর ও পরবর্তী প্রজন্মের পণ্যবাহী ট্রেন রেল পরিবহনের ক্ষেত্রে কারিগরী ও সাংগঠনিক প্রতিবন্ধকতা কমিয়ে আনবে বলে অনুমান করা হচ্ছে। এই দৃষ্টিকোণ থেকে বলা যায়, স্মার্ট শিপিংয়ের মতো প্রযুক্তিগত উন্নয়ন অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন খাতে দক্ষতা ও নিরাপত্তা বাড়ানোর পাশাপাশি খাতটিকে টেকসই রূপ দিতে ভূমিকা রাখবে। সুতরাং এ কথা অনস্বীকার্য যে, স্মার্ট শিপিংয়ের ব্যবহার শুরু হলে তার একটা প্রভাব অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন খাতে পড়বেই। সময় এখন একটি কর্মকাঠামো প্রণয়ন, যাতে করে নিরাপদ ও নির্ভরযোগ্য উপায়ে স্মার্ট শিপিং ব্যবহার করা যায়।