রেনেলের সময়ই (১৭৮৭ খ্রিস্টাব্দ) চাঁদপুর থেকে কুমিল্লা ও মনোহরগঞ্জ পর্যন্ত সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল। কুমিল্লা থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত ট্রাঙ্ক রোড আগেই ছিল। তবে ১৭৯৪ সালে ত্রিপুরা জেলা কালেক্টরেটের রিপোর্ট অনুযায়ী, সড়কগুলো পুরনো হয়ে গেলেও রাষ্ট্রীয়ভাবে মেরামতের অভাব ছিল। এছাড়া খাঁড়িগুলোর ওপর সেতু না থাকায় সড়কগুলো চলাচলের জন্য খুব একটা উপযোগী ছিল না। জুন থেকে অক্টোবর পর্যন্ত সড়কপথে যোগাযোগ ছিল এক প্রকার অসম্ভব।
১৯১০ সালে ত্রিপুরা জেলার ওপর প্রকাশিত ইস্টার্ন বেঙ্গল ডিস্ট্রিক্ট গেজেটিয়ারসের তথ্য অনুযায়ী, পরবর্তী সময়ে ১৮৯৫ সালে আসাম-বেঙ্গল রেলওয়ে ত্রিপুরা জেলায় ৭০ মাইল দীর্ঘ রেলপথ চালু করে। লাকসাম থেকে ৩২ মাইল দীর্ঘ রেলপথের একটি শাখা চাঁদপুর পর্যন্তও নেওয়া হয়। তা সত্তেও নদীপথই ছিল এ অঞ্চলে যোগাযোগের প্রধানতম মাধ্যম। বড় নৌকাগুলো সারা বছর চলাচলের উপযোগী নাব্যতা ছিল মেঘনা নদীতে। ডাকাতিয়ায় যে নাব্যতা ছিল, তাতে করে ছোট আকারের লঞ্চ সারা বছরই চলতে পারত। ডাকাতিয়া নদী দিয়ে চাঁদপুর ও শেখেরহাটের মধ্যে যোগাযোগের জন্য ১৮৭২ সালে চাঁদপুর খাল নামে একটি খালও খনন করা হয়েছিল।
নৌপথে পরিবাহিত এই যাত্রী ও পণ্য ওঠানো-নামানোর প্রয়োজনেই চাঁদপুরে ডাকাতিয়া ও মেঘনা নদীর সংগমস্থলে গড়ে উঠেছিল একটি নদীবন্দর। আনুমানিক ২০০ বছর আগে নদীবন্দরটির পত্তন বলে বলা হয়ে থাকে। এই হিসেবে বলা যায়, এটি বাংলাদেশের একটি প্রাচীন নদীবন্দর। তবে বন্দরটির ব্যাপকভিত্তিক ব্যবহার শুরু হয় ব্রিটিশ আমলে। এই সময় বন্দরটি থেকে জাহাজ ভর্তি করে পাট নিয়ে যাওয়া হতো কলকাতায়। দেশভাগের পর বন্দরটি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয় এবং ১৯৬০ সালে প্রথম যে ছয়টি নদীবন্দরের গেজেট প্রকাশ করা হয়, চাঁদপুর তার অন্যতম। স্বাধীনতার পর দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বন্দর হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে চাঁদপুর নদীবন্দর।
সীমানা
১৯৬০ সালের ১২ সেপ্টেম্বর গেজেট নোটিফিকেশনের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর পোর্টস অ্যাক্ট, ১৯০৮-এর সেকশন ৩-এর ক্লজ ৯-এর সাব-সেকশন ৭-এ প্রদত্ত ক্ষমতাবলে তৎকালীন ইস্ট পাকিস্তান ইনল্যান্ড ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট অর্ডিন্যান্স, ১৯৫৮-এর সেকশন ৩-এর আওতায় চাঁদপুর নদীবন্দরের কর্তৃত্ব ইস্ট পাকিস্তান ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট অথরিটির (ইপিডব্লিউটিএ) কাছে ন্যস্ত করা হয়। ১৯৬০ সালের ১ সেপ্টেম্বর থেকে এ আদেশ কার্যকর বলে গেজেট নোটিফিকেশনে উল্লেখ করা হয়। পাশাপাশি পোর্টস অ্যাক্ট, ১৯০৮-এর সেকশন ৪-এর সাব-সেকশন ২-এ প্রদত্ত ক্ষমতাবলে নদীবন্দরটির সীমানা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়।
পূর্ব দিকে নদীবন্দরটির সীমানা নির্ধারণ করা হয়েছে ডাকাতিয়া নদীর আড়াআড়ি উত্তর ও দক্ষিণ বরাবর ৯০০-৪০′-২০′ পূর্ব অক্ষাংশ। পশ্চিম দিকে ডাকাতিয়া নদী মেঘনার যে স্থানে পড়েছে তা থেকে পশ্চিমমুখী হয়ে পূর্বদিকে ৯০০-৩৮′-১০′ পূর্ব অক্ষাংশ এবং এই সীমার মধ্যে মেঘনার পূর্ব তীর থেকে সাধারণ ভরা কটালে পানির সর্বোচ্চ সমতল থেকে ৫০ গজ পর্যন্ত উত্তরমুখী ২৩০-১৪′-০০′ উত্তর দ্রাঘিমাংশ পর্যন্ত বিস্তৃত। এছাড়া উত্তর দিকে নদীবন্দরটি বর্ণিত পূর্ব ও পশ্চিম সীমানা বরাবর সাধারণ ভরা কটালে ডাকাতিয়ার উত্তর প্রান্তে পানির সর্বোচ্চ সমতলের তীর রেখা থেকে ৫০ গজ পর্যন্ত বিস্তৃত। আর দক্ষিণে বর্ণিত পূর্ব ও পশ্চিম সীমানা বরাবর সাধারণ ভরা কটালে ডাকাতিয়ার দক্ষিণ প্রান্তে পানির সর্বোচ্চ সমতলের তীর রেখা থেকে ৫০ গজ পর্যন্ত বিস্তৃত নদীবন্দরটি।
অর্থনৈতিক গুরুত্ব
যাত্রী পরিবহনের নিরিখে চাঁদপুর নদীবন্দর বিশেষ গুরুত্ববাহী। এই বন্দর থেকে ঢাকা ও বরিশাল রুটে নিয়মিত জাহাজ চলাচল করে। বন্দরটি ব্যবহার করে প্রতিদিন বহু মানুষ ঢাকায় পাড়ি জমায়। চট্টগ্রাম বন্দর থেকে দেশের অভ্যন্তরে পণ্য পরিবহনেও ব্যবহৃত হয় নদীবন্দরটি। এছাড়া ভারত-বাংলাদেশ পণ্য পরিবহনের জন্য যে নৌ চুক্তি সেখানেও চাঁদপুর নদীবন্দরকে রাখা হয়েছে। সবদিক দিয়ে বলা যায়, প্রাচীনকাল থেকেই গুরুত্বপূর্ণ নদীবন্দরটি সময়ের পরিক্রমায় আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে।