ছোট-বড় অসংখ্য নদীই বাংলার প্রাণ। বাংলার লোকসংস্কৃতি, মানুষের জীবন-জীবিকা সবই নদীকেন্দ্রিক। ইতিহাস ও ভুগোলের যে সহাবস্থান তাও এই নদীর কল্যাণেই। এই নদীই গ্রামবাংলার মাঠে সোনা ফলায় পলি ছড়িয়ে। এই পলিই সোনার সারমাটি। গ্রামবাংলায় সোনা ছড়ানো, বাংলাকে আকৃতি-প্রকৃতি দেওয়া এই নদীকে আশ্রয় করেই সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বেড়ে ওঠা ও মানস গঠন। বঙ্গবন্ধু তাই শাশ্বত বাংলারই প্রতিরূপ। এই মহামানবের জীবনে নদীর ভূমিকা ব্যাপক।
জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে ২৬ ডিসেম্বর নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় আয়োজিত ‘বঙ্গবন্ধু : শাশ্বত বাংলার প্রতিরূপ’ শীর্ষক সেমিনারে অতিথিদের আলোচনায় বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে এসব কথাই উঠে আসে। নারায়ণগঞ্জ ড্রেজার বেইজ থেকে ছেড়ে যাওয়া বিআইডব্লিউটিএর পরিদর্শী জাহাজে সেমিনারটি অনুষ্ঠিত হয়। এতে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসের বঙ্গবন্ধু চেয়ার ও ইতিহাসবিদ অধ্যাপক ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন। মূল প্রবন্ধে তিনি বঙ্গবন্ধুর মানস গঠনে নদীর ভূমিকা নিয়ে আলোচনা করেন। আলোকপাত করেন নদী ও প্রকৃতি রক্ষায় বঙ্গবন্ধুর দূরদর্শীতা, প্রজ্ঞা ও উদ্যোগ নিয়ে।
সেমিনারে প্রধান অতিথি ছিলেন তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ এমপি। দেশের শিরা-উপশিরা স্বরূপ অমিত সম্ভাবনা জাগানিয়া নদ-নদী রক্ষা যে কত গুরুত্বপূর্ণ ড. হাছান মাহমুদ তাঁর বক্তৃতায় তা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পর গর্বিত জাতিকে স্বপ্নের ঠিকানায় নিয়ে যেতে নদীমাতৃক বাংলাদেশের শিরা-উপশিরার মতো নদ-নদীগুলোকে রক্ষা করা অতীব গুরুত্বপূর্ণ। নদীবাহিত পলি সমাবেশে নতুন জমি জেগে ওঠার উদাহরণ যেমন রয়েছে, তেমনি আছে ভবিষ্যৎ অমিত সম্ভাবনা। মানুষের শিরা-উপশিরা দূষিত হলে, শুকিয়ে গেলে মানুষ যেমন রুগ্ণ হয়, তেমনি নদী দূষিত হলে, দখল হলে, শুকিয়ে গেলে বাংলাদেশটাও শুকিয়ে যায়, দূষিত হয়ে যায়। তাই নদী রক্ষা করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
জাতির পিতার জীবনে নদীর ভূমিকা বর্ণনা করতে গিয়ে ড. হাছান মাহমুদ বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনে নদীর অনেক প্রভাব। বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার এবং আমাদের জীবনেও নদীর প্রভাব অনেক।
জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে সবকিছুই আজ আক্রান্ত। তার পরও বাংলাদেশের সামনে সম্ভাবনা যে অফুরন্ত সেই কথা জানিয়ে পরিবেশবিদ ড. হাছান মাহমুদ বলেন, দেশে প্রবাহিত ৫৭টি যৌথ নদী বছরে প্রায় দুই বিলিয়ন টন পলি বহন করে এবং সমুদ্রের তলদেশে তা জমা হয়। এতে সমুদ্র থেকে নতুন জমি উদ্ধারের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। এরই মধ্যে অনেক জমি উদ্ধার হয়েছে। আজকের যে ভাসানচর সাত বছর আগে তা ছিল না। নোয়াখালীর সুবর্ণচর উপজেলা দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে ছিল না। পরিপূর্ণভাবে একটি নতুন উপজেলা গঠিত হয়েছে। অর্থাৎ সমুদ্র থেকে জমি উত্তোলনের বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি বিবেচনায় নিয়ে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অংশ হিসেবে সরকার ব-দ্বীপ পরিকল্পনা ২১০০ প্রণয়ন করেছে। এটি নিয়ে আরও কাজ করা প্রয়োজন বলে মনে করেন ড. হাছান মাহমুদ। তিনি বলেন, কয়েক দশকের পরিকল্পনা নিয়ে এগোলে সমুদ্র থেকে বিরাট একটি অংশ আমাদের দেশের সাথে যুক্ত করতে আমরা সক্ষম হব।
এ অঞ্চলের নদীগুলো বিপুল পরিমাণ পলি বহন করায় নাব্যতা কমে যাওয়া একটি বড় সমস্যা। বিদ্যমান নৌপথগুলোর নাব্যতা রক্ষার পাশাপাশি অনাব্য নৌপথগুলো খননের মাধ্যমে পুনরুদ্ধারের বিরাট কর্মযজ্ঞ পরিচালনা করছে বিআইডব্লিউটিএ। এজন্য আন্তঃদেশীয় পরিকল্পনার ওপর জোর দেন তথ্যমন্ত্রী। তিনি বলেন, আমাদের বড় নদীগুলোর ক্যাচমেন্ট এরিয়ার ৯৩ শতাংশই বাংলাদেশের বাইরে ভারত, ভুটান ও নেপালে। বাকি মাত্র ৭ শতাংশ বাংলাদেশের ভূমিতে। তাই নৌপথ উদ্ধারের পরিকল্পনা আন্তঃদেশীয় পরিকল্পনার অংশ হতে হবে।
নদীর সুষ্ঠু ব্যবহারে উদ্যোগ নেওয়ার জন্য নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী এমপিকে ধন্যবাদ জানান তথ্যমন্ত্রী। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু যেভাবে নদীকে ব্যবহার করে বাংলাদেশের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার কথা ভাবতেন, সেই পথ ধরেই নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় কার্যক্রম হাতে নিয়েছে। দুই হাজার কিলোমিটারের বেশি নদীপথ এরই মধ্যে উদ্ধার হয়েছে এবং আরও নদীপথ উদ্ধারের জন্য ড্রেজার ও জাহাজ কেনা হয়েছে। দলমতের ঊর্ধ্বে উঠে প্রতিমন্ত্রী নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন।
জাতির পিতার বেড়ে ওঠা নদীর সাথে, নদীর তীরে। তাই নদীর কল্যাণের, নদীর মাধ্যমে দেশ ও জাতির কল্যাণের চিন্তাভাবনা করেছেন গভীরভাবে। নদীর বহমানতা ও বিশালতা নিজের মধ্যে ধারণ করে বঙ্গবন্ধু নিজেও হয়েছিলেন মহানুভব এক মানুষ। বঙ্গবন্ধুর মতোই তার রক্তের উত্তরাধিকার মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিকে পথ দেখাচ্ছেন বলে মন্তব্য করেন নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী এমপি।
প্রধানমন্ত্রীকে উদ্ধৃত করে নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী বলেন, নদীগুলো হচ্ছে বাংলাদেশের শিরা-উপশিরা। নদীগুলো রক্ষা করতে হবে। আজকে প্রধানমন্ত্রী সেভাবে নির্দেশনা দিচ্ছেন। এ পথ ধরে নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয় দেশের অর্থনীতিতে আরও সহায়ক শক্তি হতে পারে। সা¤প্রতিক যে ঘটনাগুলোর কারণে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি, সে বিষয়ে সবাইকে আরও আন্তরিক হতে হবে।
মানুষের জীবনের সাথে নদীর কোথায় যেন একটা সম্পর্ক আছে বলে মন্তব্য করেন নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি মেজর (অব.) রফিকুল ইসলাম, বীর উত্তম। যে সম্পর্ক তিনি নিজেও খুব বেশি উপলব্ধি করতে পারেন এবং এখনো করেন। সেমিনারে বিশেষ অতিথির বক্তৃতায় তিনি বলেন, নদীর সাথে আমাদের একাত্মতা অনুধাবন করতে হবে। নদীকে যদি আমরা ভালো না বাসি তাহলে আমরা নদীকে রক্ষা করতে পারব না। একদিকে নদী মরে গেছে, আরেকদিকে নদী দূষিত হয়ে গেছে। কোনো বহমান নদী যদি দূষিত হয় তখন তা আর সম্পদ থাকে না, বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। নদী দূষিত হয়ে আমাদের জীবনকে দুর্বিসহ করে তুলছে।
জাতির পিতার শৈশব কেটেছে মধুমতীর তীরে। নদীটির প্রতি তাঁর ছিল প্রবল ভালোবাসা। সেই নদীই আজ বিপন্ন বলে মন্তব্য করেন মেজর (অব.) রফিকুল ইসলাম, বীর উত্তম। তিনি বলেন, নদী আমাদের জীবনে কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা আমরা অনুধাবন করি নদীটি মরে গেলে। এজন্য নদী রক্ষায় মন্ত্রণালয় আপ্রাণ চেষ্টা করছে। কিন্তু যারা নদীগুলো দখল করছে তারা এতটাই দুষ্টু প্রকৃতির যে তাদের সাথে মন্ত্রণালয় যেন কুলিয়ে উঠতে পারছে না। শুধু একটা এলাকায় বা বড় নদীগুলো নয়, ছোট নদীগুলো তো প্রায় দখলই হয়ে গেছে। আমাদের এ ব্যাপারে খেয়াল রাখতে হবে।
বক্তব্যের শেষাংশে এসে তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুকে স্মরণ করার এর চেয়ে ভালো উপলক্ষ আর হতে পারে না। তিনি নিজে নদীকে ভালোবেসেছেন। নদীকেন্দ্রিক অনেক কর্মকাণ্ড করেছেন। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে আমাদের নদীগুলো রক্ষায় আন্তরিক হতে হবে। এগুলোর দূষণ রোধ করতে হবে। এজন্য যে যে পদক্ষেপ প্রয়োজন তা নিতে হবে। মনে রাখতে হবে, নদী যদি না বাঁচে তাহলে আমরা বাঁচতে পারব না। আমরা যদি আমাদের দেশকে মরুভূমিতে পরিণত করতে না দিই তাহলে নদীকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আমরা অনেক নদী উদ্ধার করতে কিছুটা সফল হয়েছি। আমার বিশ্বাস আছে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে আমরা অবশিষ্ট নদীও উদ্ধার করতে সক্ষম হব। বঙ্গবন্ধুর পরে ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের আগে কোনো সরকারই নদীর প্রতি দৃষ্টি দেয়নি। আমরাই দিয়েছি।
সমাপনী বক্তব্যে সেমিনারের সভাপতি নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সচিব মোহাম্মদ মেজবাহ উদ্দিন চৌধুরী ঝালকাঠিতে মর্মান্তিক নৌ-দুর্ঘটনায় গভীর বেদনার কথা উল্লেখ করেন। সেই সাথে নৌ-ব্যবস্থাপনার সার্বিক উন্নয়নের ওপর জোর দেন এবং এ ধরনের মর্মান্তিক ঘটনার যাতে পুনরাবৃত্তি না ঘটে সেজন্য দৃঢ় শপথ গ্রহণ ও সেই শপথ বাস্তবায়নের আহবান জানান। তিনি বলেন, বাংলাদেশ যদি হয় শাশ্বত, চিরদিনের তাহলে বঙ্গবন্ধুও চিরদিনের। বঙ্গবন্ধুকে মুছে দেওয়া যাবে না। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে ২০৪১ সালে উন্নত দেশ হওয়ার যে লক্ষ্য এবং শতবর্ষী যে ব-দ্বীপ পরিকল্পনা ২১০০ তার অনুপ্রেরণাও বঙ্গবন্ধুর থেকেই উৎসারিত।
সেমিনারের প্রতিপাদ্যের ওপর আলোচনা করেন দৈনিক অবজারভারের সম্পাদক ইকবাল সোবহান চৌধুরী, মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল মোহাম্মদ মুসা, পরিবেশবিদ অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ, বিআইডব্লিউটিসির চেয়ারম্যান আহমেদ শামীম আল রাজী, নৌপরিবহন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক কমডোর আবু সালেহ মো. জালাল উদ্দিন, বাংলাদেশ মেরিন একাডেমির কমান্ড্যান্ট ড. সাজিদ হোসেন ও নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব সঞ্জয় কুমার ভৌমিক।
সেমিনারে আগত অতিথি ও অংশগ্রহণকারীদের ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন বিআইডব্লিউটিএর চেয়ারম্যান কমডোর গোলাম সাদেক। তিনি বলেন, যে ঘাটটি থেকে আমরা যাত্রা করেছি সেই খানপুর বঙ্গবন্ধুর পদধন্য একটি ঘাট। এখানেই বঙ্গবন্ধু বিদেশি অতিথিদের নৌবিহারের জন্য নিয়ে আসতেন এবং তিনি নিজেও এখান থেকে নৌযানে করে গোপালগঞ্জে গিয়েছেন। তাই সেমিনারের জন্য এই স্থানটিকে নির্বাচন করায় নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়কে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। শীতলক্ষ্যা ও মেঘনা ছিল বঙ্গবন্ধুর প্রিয় নদী, প্রিয় যাত্রাপথ। আর যে জাহাজটিতে আমরা সেমিনারের আয়োজন করেছি সেটি কিছুদিন আগে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমাদের উপহার দিয়েছেন। এই প্রজন্মের যারা অর্থাৎ বঙ্গবন্ধুকে যারা দেখেনি, মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি যাদের সরাসরি নাড়া দেয়নি তারা সম্মানিত আলোচকদের কাছ থেকে অনেক অজানা তথ্য জানতে পারলেন। বঙ্গবন্ধু তাদের কাছে আরও ভাস্বর হয়ে উঠলেন।